উইমেন বিজনেস সেন্টার: গ্রামীণ নারীদের ভাগ্যের পরিবর্তন

17-09-2022

বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে বাল্য বিবাহের সম্ভাবনা, স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়া, সংসারের আর্থিক বিষয়ে মত প্রকাশের অধিকার না থাকার মত বিষয়গুলো। শেষ পর্যন্ত তাদের গৃহিণী পরিচয়েই বেঁচে থাকতে হয় যেখানে তাদের কাজের কোনো মূল্যায়ন বা স্বীকৃতি নেই। নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ সুবিধা না থাকায় তাদের একটি দুর্বিষহ জীবন বয়ে বেড়াতে হয়।

বিশ্বজুড়ে প্রান্তিক মানুষরা প্রতিনিয়ত যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তা মোকাবেলা করার জন্য ১৯৮৪ সালে কোকা কোলার প্রথম আন্তর্জাতিক জনকল্যাণমূলক সংস্থা, দ্য কোকা কোলা ফাউন্ডেশন চালু হয় এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কোকা কোলা কোম্পানি ২০১০ সালে ফাইভ বাই টুয়েন্টি (5by20) ঘোষণা করে। ২০২০ সালের মধ্যে ৫০ লক্ষ নারী উদ্যোক্তাকে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন করাই এই বৈশ্বিক উদ্যোগের উদ্দেশ্য।

আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উইমেন বিজনেস সেন্টার (WBC) ধারণার জন্ম এখান থেকেই। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউনাইটেড পারপাস এবং দ্য কোকা কোলা ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে এই এই বিজনেস সেন্টারগুলো স্থাপন করা হয় এবং এগুলো পরিচালনার দায়িত্ত্বে থাকেন নারীরা। গ্রামীণ এলাকায় ডব্লিউবিসি-এর কার্যক্রম এবং বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের আর্থিক ক্ষমতায়নে এর ভূমিকা সম্পর্কে সরাসরি ধারণা দিতে মিডিয়া কর্মীদের একটি দলকে নিয়ে বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ এবং টুঙ্গিপাড়ায় একটি সফরের আয়োজন করা হয়।

"আমি পুরোপুরি আমার স্বামীর আয়ের উপর নির্ভরশীল ছিলাম এবং সংসারে কোনো টাকাপয়সা দিতে পারতাম না। আমি বিএ পাশ করেছি এবং আমার পরিবারের অবস্থার উন্নতির জন্য কিছু করার সিদ্ধান্ত নেই। তাই, আমি কোকা কোলা ফাউন্ডেশন থেকে বিজনেস মার্কেটিং এবং কমিউনিকেশন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এছাড়াও আমি টেইলারিং, কম্পিউটার অপারেটিং এবং পিএইচ পরীক্ষা করার কোর্সে ভর্তি হই।" এমনটাই বলছিলেন উন্নতি মন্ডল। তিনি ২০১৭ সাল থেকে বাগেরহাটের পিপড়াডাঙ্গায় একটি ডব্লিউবিসি পরিচালনা করে আসছেন৷

গোপালগঞ্জের ডিসি শাহিদা সুলতানা কর্মশালার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখছেন

পিপরাডাঙ্গায় ডব্লিউবিসি চালুর পর থেকে, অন্যান্য মহিলা উদ্যোক্তাদের মতো উন্নতি মণ্ডলও চারজন মহিলা উদ্যোক্তাকে সাথে নিয়ে তার ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ডব্লিউবিসি হল একটি পারস্পরিক সহযোগিতা-ভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেল, যেখানে উন্নতি মন্ডলের মত উদ্যোক্তারা অন্যান্য উদ্যোক্তাদের সাথে মিলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তাদের সক্ষমতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে মূলধন বা পণ্য সরবরাহ করে ব্যবসায় অবদান রাখেন এবং সবার সাথে মুনাফা ভাগাভাগি করে নেন। কোকা কোলা ফাউন্ডেশন ফ্রিজার, ল্যাপটপ, পিএইচ টেস্ট কিট এবং ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে।

আর্থিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি কমিউনিটি-ভিত্তিক মডেলের সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি।

সন্তোষপুর উইমেন বিজনেস সেন্টারের একজন উদ্যোক্তা তোপোতি রানী মজুমদার একটি মুদি দোকানের পাশাপাশি নিরাপদ সবজি এবং মাছ চাষ করছেন। তিনি অন্যান্য উদ্যোক্তাদের সহায়তায় মুদিপণ্য, শাকসবজি, বাচ্চাদের খাবার ইত্যাদি বিক্রি করছেন।

তপোতী রানী মজুমদার এখন একজন সফল উদ্যোক্তা কিন্তু অধিকাংশ গ্রামীণ নারীর মতো তিনিও বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন।

"শুরুর সময়টা খুব কঠিন ছিল। পুরুষদের মতো আমরাও ব্যবসা করার চেষ্টা করছি বলে সবাই আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করতো। আমাদের কঠোর পরিশ্রম দেখার পরে সেই একই মানুষরা শুধুমাত্র তাদের দৃষ্টিভঙ্গিই পরিবর্তন করেনি, আমাদের গ্রাহক হয়ে আমাদের সমর্থনও করছে। এটি আমাদের আরও আত্মবিশ্বাসী করেছে এবং আমরাও আমাদের নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কেও ধারণা পেয়েছি" এমনটাই বলছিলেন তপোতী।

এই উইমেন বিজনেস সেন্টারের সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঐক্য। আর তাদের সকলেরই মূল লক্ষ্য একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ। এ থেকে বোঝা যায়, গ্রামীণ মহিলাদের মাঝে উদ্যোক্তার হওয়ার প্রবল আগ্রহ যেমন আছে, পাশাপাশি তাদের নিজেদের মধ্যে সংহতিও রয়েছে।

"আমার সহ-উদ্যোক্তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবসায় অবদান রাখেন। মুনাফা ভাগাভাগির সময়, আমরা যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটাই নিয়ে থাকি এবং বাকীটা ব্যবসার উন্নতির জন্য কাজে লাগাই। পিপড়াডাঙ্গা ডব্লিউবিসি-র আরেকজন উদ্যোক্তা মনিকা বারৈ বলেন, "মুদি দোকানের পাশাপাশি, মানুষকে কম্পিউটার সাক্ষরতা বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি কম্পিউটার সেন্টার খোলার পরিকল্পনা করছি।"

নারী উদ্যোক্তাদের পরিদর্শনের পাশাপাশি "নারীর সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে উইমেন বিজনেস সেন্টারের ভূমিকা" শীর্ষক একটি কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়, যেখানে খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জসহ অন্যান্য জেলা থেকে ডব্লিউবিসির উদ্যোক্তাসহ প্রায় ৫০ জন অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গোপালগঞ্জ জেলার ডিসি শাহিদা সুলতানা এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার ইউএনও মোঃ আল মামুন।