কোকা-কোলা বাংলাদেশের পথচলা

30-06-2022

বন্ধুবান্ধব বা পারিবারিক কোন দাওয়াত কিংবা প্রিয়জনের সাথে আড্ডা, এক বোতল কোমল পানীয় ছাড়া কোনো আলাপচারিতা বা দাওয়াতই যেন জমে ওঠে না। কোমল পানীয়ের কথা চিন্তা করলেই বাজারের অন্য সব ব্র্যান্ডের কথা বাদ দিয়ে প্রথম যে নামটি আমাদের মাথায় আসে তা হল কোকা-কোলা

কোকা-কোলা বিশ্বের অন্যতম পুরনো কার্বনেটেড পানীয় উৎপাদনকারী এবং বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত। অনন্য স্বাদ এবং বিশ্বব্যাপী তাদের মার্কেটিং কৌশলের জন্য তারা আজ এই অবস্থানে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

এখন প্রস্ন উঠতে পারে: তারা এটা কীভাবে করলো? কোকা-কোলা কীভাবে একটি অজানা ব্র্যান্ড থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে পছন্দের ব্র্যান্ড হয়ে উঠলো সেই গল্প শোনা যাক।

বাংলাদেশে কোকা-কোলার যাত্রা শুরুর গল্প

বাংলাদেশে কোকা-কোলা তাবানি বেভারেজের (টিবিসিএল) মাধ্যমে ঢাকায় এবং কে রাহমান-এর মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে ১৯৬২ সালে। এখানে উল্লেখ্য যে কোকা-কোলা বাংলাদেশে যখন যাত্রা শুরু করেছিল তখন দেশের মানুষ নানা বৈচিত্র্যময় স্বাদ গ্রহণ করছিলেন, যার ফলে কোমল পানীয় পছন্দ করার একটি সাধারণ অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়। এ ছাড়া কোকা-কোলা বাংলাদেশের কাছে ছিল মানুষের সবচেয়ে পছন্দের ব্র্যান্ড হওয়ার হিসেব। সচেতনতার অভাব, পণ্য সম্পর্কে ধারণা না থাকা এবং অপর্যাপ্ত বিপণনের কারণে শুরুতে কঠিন সময় পার করলেও পরবর্তীতে এর ব্যবসায় গতি আসে।

ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার পথে

১৯৮২ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আব্দুল মোনেম লিমিটেড (এএমএল)-এর পানীয় ইউনিট কোকা-কোলার ফ্র্যাঞ্চাইজি বোতলজাতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। কোম্পানিটি ১৯৮৭ সালে কুমিল্লায় তার পূর্ণাঙ্গ বোতলজাতকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করে। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি কোকা-কোলা বাংলাদেশের প্রধান প্রধান বাজারের বোতলজাতকরণ, প্যাকেজিং, বিক্রয় এবং বিতরণের দায়িত্ব পালন করছে। এই ব্র্যান্ডের বয়স যখন ২০ বছর পার হয়, তখন বেশ কিছু স্থানীয় পানীয় বাজারে আসে। ধারণা করা হয় আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড তাদের কার্বনেটেড পানীয় বাজারে নিয়ে আসে।

এদিকে, কোকা-কোলার পাশপাশি পেপসিকোও দেশে কাজ করছিল। তাই বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাচ্ছিল। সেটা অনেকটা প্রত্যাশিতই ছিল। এক গবেষণায় দেখা যায় যে কোকা-কোলা তার শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং শীর্ষ-স্তরের কোম্পানিগুলো দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোকে অনুসরণ করছে। বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন তাপস কুমার মন্ডল এবং আবদুল মোনেম লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম।

বাজার সেরা হয়ে উঠা

ধীরে ধীরে কোকা-কোলার বাজার বাড়তে থাকে এবং ১৯৯০ সালে টিসিসিসি (কোকা-কোলা কোম্পানির সংক্ষিপ্ত রূপ) বাংলাদেশের বাজারের ৭০% দখল করে অপ্রতিদ্বন্দ্বী কোমল পানীয় ব্র্যান্ডে পরিণত হয়।

পানীয় বাজারে আধিপত্য

পরবর্তীতে, ২০১০ সালে ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজেস প্রাইভেট লিমিটেড (আইবিপিএল) বাংলাদেশে টিসিসিসি-এর বোতলজাতকারী বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে, যা কোমল পানীয় ব্র্যান্ডের ধারাবাহিক সাফল্যেরই নিদর্শন। সেই সময়ে, দেশীয় ব্র্যান্ডের পানীয় থাকা সত্ত্বেও মানুষ কোকা-কোলার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে এবং এই পানীয়টি পছন্দ করে। আর এটিই তাদের ব্র্যান্ডকে আধিপত্য দিয়েছে।

কোকা-কোলা, আমি সেন্ট মার্টিনকে পরিষ্কার রাখি ক্যাম্পেইন

টেকসই উদ্যোগগমূহ

ব্যবসার পাশাপাশি, কোকা-কোলা বাংলাদেশে তার যাত্রার শুরু থেকেই মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের এসব উদ্যোগের অংশ হিসাবে, ২০১১ সালে, তারা দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে কেওক্রাডং-এর সহযোগিতায় বাংলাদেশে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। যদিও ২০২১ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ কার্যক্রমের ১১তম সংস্করণ সম্পন্ন হয়। গত দশ বছরে, এই উদ্যোগের আওতায় ১২,০০০ কেজিরও বেশি সামুদ্রিক আবর্জনা সংগ্রহ করেছে। ৪৫০০ জনের বেশি স্বেচ্ছাসেবক এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন।

সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা

প্রতিষ্ঠানটি যেসব দেশে কাজ করছে সেসব দেশের বিভিন্ন সামাজিক বিষয় নিয়ে তাদের নানা কার্যক্রম রয়েছে এবং তাদের এসব উদ্যোগ অত্যন্ত সফল। তাই, ২০১৬ সালে দেশব্যাপী নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য উইমেন বিজনেস সেন্টারের প্রজেক্ট চালু করা হয়। ২০১৭ সালে, তারা ওয়াটারএইড নামক প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে উপকূলীয় এলাকায় ওয়াশ অ্যান্ড হাইজিন প্রকল্পের সূচনা করে এবং তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য ময়মনসিংহের ভালুকায় আইবিপিএল-এর একটি কারখানা স্থাপন করে।

কৃষিশিল্পে অবদান

২০১৯ সালে, কোকা-কোলা পানি সংকটে আক্রান্ত বরেন্দ্র অঞ্চলে ১০,০০০ কৃষককে সম্পৃক্ত করে কৃষিকাজের জন্য পানি সংরক্ষণ প্রকল্প চালু করেছিল এবং পরবর্তীতে এই প্রকল্পের আওতায় তারা পানি সংরক্ষণের অংশ হিসাবে আইবিপিএল প্ল্যান্টে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করেছে।

নারীর ক্ষমতায়ন

মানবজীবনের উন্নতি, টেকসই পরিবেশ সৃষ্টি এবং সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার জন্য অনেক প্রকল্প গ্রহণ করার পর, এরই ধারাবাহিকতায় কোকা-কোলা ২০১৯ সালে ১০০,০০০ নারীর ক্ষমতায়নের মাইলফলক ছুঁয়েছে এবং ২০২১ সালে ১১তম ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। এছাড়াও, কোকা-কোলা ফাউন্ডেশন, ইউনাইটেড পারপাসের সহযোগিতায় ৪০,০০০ নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ২০২২ সালে সুনামগঞ্জ এবং গোপালগঞ্জে ৩০টি নতুন উইমেন বিজনেস সেন্টার চালু করেছে।

ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি সফর

কোমল পানীয় শিল্পে পরিনত ব্র্যান্ড

একদিকে কোকা-কোলা একটি উন্নত ভবিষ্যত গড়ার জন্য যেমন নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে, অপরদিকে প্রতিষ্ঠানটি তার ভোক্তাদের আরো ভাল স্বাদ উপহার দেওয়া থেকে দূরে সরে যায়নি। এছাড়াও, ব্র্যান্ডটি কিছু পানীয় বাজারে এনেছে যা জীবনের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ পছন্দ করবে। “অনুভূতির স্বাদ নিন”- স্লোগান নিয়ে তারা বর্তমানে দেশে কাজ করছে।

বাংলাদেশে নতুন বোতলজাতকরণ প্ল্যান্ট

২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি, কোকা-কোলা কোম্পানির একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেড দেশে ৭৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ভালুকায় একটি বোতলজাতকরণ কারখানার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এ.এম.এ. মুহিত। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। নতুন এই স্থাপনাটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসা উন্নয়ন এবং স্থানীয় সমাজের টেকসই উন্নয়নে চলমান প্রতিশ্রুতিরই অংশ।

বাংলাদেশে কোক স্টুডিও কনসার্ট

কোক স্টুডিও বাংলার যাত্রা শুরু

সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি কোকা-কোলা ২০২২ সালে, আন্তর্জাতিক মিউজিক প্রোপার্টি - কোক স্টুডিওর বাংলাদেশ সংস্করণ, কোক স্টুডিও বাংলা চালুর ঘোষণা দেয়। এরই মধ্যে এটি দেশের অন্যতম ট্রেন্ডিং সংগীত প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৬,৩৭,০০০ এবং কোক স্টুডিও বাংলার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ফলোয়ার সংখ্যা ২,১৪,৭৮৯।

সম্প্রতি, বাংলাদেশের সকল ফুটবলপ্রেমীদের জন্য কোকা-কোলা বিশ্বব্যাপী ফিফা বিশ্বকাপ™ ট্রফি ভ্রমণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে এসেছে। বিশ্বকাপ ট্রফির আগমন উপলক্ষ্যে ভক্তদের জন্য কোকা-কোলা বাংলাদেশ লিমিটেড প্রথমবারের মতো কোক স্টুডিও বাংলা লাইভ কনসার্টের আয়োজন করে। কনসার্টটি বছরের সবচেয়ে আলোচিত ইভেন্টে পরিণত হয়ে এবং অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই এর খুব প্রশংসা করে।

কেন এই ব্র্যান্ডটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তার কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটি তার ব্র্যান্ড সচেতনতার ওপর গুরুত্ব প্রদান করে আসছে। নিঃসন্দেহে, ব্র্যান্ড সচেতনতা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা একটি ব্র্যান্ডকে একজন গ্রাহকের মনে গেঁথে দেয়। এর ফলে যখনই একজন গ্রাহক কোনো পণ্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবেন, তখনই সবার আগে সেই ব্র্যান্ডটির কথা তার মাথায় আসবে। অন্যান্য কোমল পানীয় কোম্পানিগুলি এই বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়, আর কোকা-কোলা সেই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগায়৷