কোক স্টুডিও বাংলা কনসার্ট: নৈরাশ্যের বিরুদ্ধে সংগীত জয়ী হয়েছিল যে রাতে

11-06-2022

প্রথমেই আলোকপাত করা যাক অনালোচ্য বিষয়টির দিকে: কোক স্টুডিও বাংলা নিশ্চিতভাবেই কোকা কোলার জন্য একটি সুপরিসর বিজ্ঞাপন। এই উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য বিশাল কোনো পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, গতকাল আর্মি স্টেডিয়ামের মঞ্চের শীর্ষে কোকা কোলার বিশাল লোগোটিই ‘ইঙ্গিত’ হিসেবে যথেষ্ট হওয়া উচিত।

তা সত্ত্বেও, প্ল্যাটফর্মটি আমাদের স্থানীয় প্রেক্ষাপটে আগ্রহ পুনরায় উসকে দেয়ার জন্য যা করেছে তা প্রশংসনীয়, দিনভর অবিরাম বৃষ্টি সত্ত্বেও বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে হাজারও মানুষের ঢলে কেবল সেটিই প্রমাণ হয়।

সে রাতে দর্শক মাতিয়েছিল লালন ব্যান্ড।

দর্শকদের প্রতীক্ষার তীব্রতা ছিল বিভিন্ন কারণেই: কনসার্টের ভবিষ্যৎ যখন পুরোটাই সৃষ্টিকর্তার হাতে, ওই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন পরিণত হয় এক ভার্চুয়াল যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখানে অনকেই আমাদের মতো মানুষদের দুর্দশা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসিঠাট্টায় মেতেছিলেন যারা কি না কনসার্ট বাতিলের গুজবের মধ্যেও বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে অপেক্ষা করছিলাম। কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের মিম তৈরি করছিলেন, কেউ প্রতিবাদও করছিলেন এবং এর জের ধরে কিছু অদ্ভুত ‘পাল্টা প্রতিবাদ’ও দেখা গেল, যেখানে হাস্যরসের ঝাণ্ডাবাহী হিসেবে দাবি করা ব্যক্তিরা ‘যেকোনো কিছু নিয়েই মজা করা যায়’ দর্শনের প্রচার করতে শুরু করলেন।

কোক স্টুডিও বাংলার শিল্পীদের মূল দলটি ছিল দারুণ।

কনসার্টের ভেন্যুতে পৌঁছানো মাত্রই আমি মানসিকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই সেই রঙ্গ-রসিকতা থেকে বেরিয়ে এলাম, যেখানে ঝড়ে আংশিক ভেঙে যাওয়া মঞ্চটি নতুন করে সাজানো প্রয়াসটি চমৎকারভাবে চলছিল। সব সংশয়ের অবসান ঘটল যখন কোক স্টুডিও বাংলার এই সিজনের অরিজিনাল প্রোমো গানটি গাওয়ার জন্য অর্ণব ও সহযোগীরা মঞ্চে উঠলেন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘একলা চলো রে’, গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ এবং শিরোনামহীনের ‘আবার হাসিমুখে’র একটি ম্যাশআপ ছিল সেটি।

'বরাবরের মতোই গুরু জেমস ছিলেন অতুলনীয়।

ওই সময় থেকে উপস্থিত দর্শকরা যেন সবকিছু গোগ্রাসে গিলতে থাকলেন। আয়োজনের দিক থেকে এটি আর দশটি কনসার্টের চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না— সাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা (শব্দ প্রকৌশলীরা) যন্ত্রশিল্পীদের চাহিদামতো মনিটরে যথাযথ রেফারেন্স দিতে পারছিলেন না, শিল্পীরা বারবার ভলিউম সমন্বয় করতে বলছিলেন, কিংবা স্পটলাইটটি কোথায় থাকা প্রয়োজন সেটি নিয়েও বারবার অনুযোগ করেছে। আউটপুটগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের জন্য বেশ কয়েকটি পরিবেশনা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

সাউন্ড নিয়ে যারা কাজ করছিলেন, তাদের একেবারেই ভিন্ন একটি পরিস্থিতিতে কাজ করতে হচ্ছিল, ৩২-চ্যানেলে তাদের অরিজিনাল ৪০-চ্যানেলের আউটপুটের জায়গা করে দিতে হচ্ছিল। এটি বিবেচনায় নিলে বলা যায়, তারা সত্যিই তাদের সর্বোচ্চটুকু ঢেলে দিয়েছেন।

মিজান এবং মমতাজ বেগম পরিবেশন করলেন ‘প্রার্থনা’।

তবে উপস্থিত দর্শকদের কাছে এর কিছুই বড় কোনো বিষয় ছিল না। তারা সবাই চমৎকার একটি সময় উপভোগ করছিলেন। তারা কেবল অর্ণব, অনিমেষ রায়, বগা তালেব, ঋতু রাজ, নন্দিতা, মমতাজ বেগম ও মিজানের গানের সঙ্গে গলাই মেলাচ্ছিলেন না, তারা জালালি সেটের র‍্যাপ অংশের সঙ্গেও মেতে উঠছিলেন এমনকি বাঁশির জাদুকর জালাল আহমেদের ‘নিথুয়া পাথারে’র সুরের সঙ্গেও গেয়ে উঠছিলেন তারা।

তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে, ঠিক এই সময় আপনি অনুধাবন করলেন হয়তো বৃষ্টি থেকে ভালো কিছুও বের হয়ে এসেছে, প্রকৃত অর্থে সবচেয়ে নিবেদিত কিছু সংগীতপ্রেমীই একদম শেষ পর্যন্ত সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

তাহসান তার পরিবেশনার সময় দৃশ্যতই খুব আবেগঘন ছিলেন।
নেমেসিস ছিল জ্বলন্ত আগুনের মতো।

তাদের প্রত্যেকের পরিবেশনাই সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে। তাহসান তার ‘ঈর্ষা’ ও ‘আলো’ গান দিয়ে দর্শকদের সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও স্মৃতির সরণি ঘুরিয়ে আনলেন, দর্শকরা নেমেসিসের ‘কবে’ গানের সঙ্গে উদ্বেল হয়ে উঠলেন, লালন ব্যান্ড তাদের ‘পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না’ গাইলেন দুইটি ভিন্ন সংস্করণে, প্রথমবার জালালি সেটের সঙ্গে কোক স্টুডিও সংস্করণে, পরে নিজেদের আদি সংস্করণে। ওয়ারফেজ ও নগর বাউল তাদের পরিবেশনা দিয়ে প্রমাণ করলেন, দশকের পর দশক পরও তাদের পরিবেশনা এতটুকুও আবেদন হারায়নি।

আমার বিবেচনায় গোটা ইভেন্টের দুঃখজনক ঘটনা ছিল যখন প্রতিশ্রুতিশীল দুটি ব্যান্ড আরেকটা রক ব্যান্ড ও ইন্ট্রোইট সেখানে পরিবেশনার সুযোগ পেল না। ওই ব্যান্ড সদস্যদের জন্য আমি সমব্যথী, তবে তারা চ্যাম্পিয়নদের মতোই ঠিক ফিরে আসবে বলেও আমি নিশ্চিত।

কনসার্টে গান পরিবেশনরত ওয়ারফেজ।

এত কিছু বলার পরও বলতে চাই, সেদিন দীর্ঘ সময়ের সিদ্ধান্তহীনতা সত্ত্বেও আয়োজকদের কনসার্ট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে অনেকেই সেদিনের বিপুল পরিমাণ কারিগরি জটিলতার বিষয়টি স্মরণে রাখবেন না। উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধানে বিপুল কর্মযজ্ঞ এবং বারবার বদলে যাওয়া পরিকল্পনা কার্যকরের বিষয়টি ছিল দৃশ্যমান, যা তাৎক্ষণিকভাবে উদার ও অনুরাগী দর্শকরা অগ্রাহ্য করে দিয়েছেন। কোক স্টুডিও কনসার্টটি অদম্য কিছু সংগীতশিল্পীর কাছে একটি গোটা দিনের নেতিবাচকতা ও অনলাইন ট্রলিংয়ের পরাজয় হিসেবেই স্মরণে থেকে যায়।